রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৫২ পূর্বাহ্ন
শামীম আজাদ:
সত্যি চলে গেলেন বরেণ্য সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামনিস্ট ও মহান একুশের অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী! আমাদের দেশ ও জাতি হারাল তার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটি হারাল তাদের বাতিঘর ও অভিভাবককে।
সবার মতো এভাবেই আমার অতি কাছের মানুষ প্রিয় গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে বলতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছে, এই বিয়োগব্যথার মধ্যেও একটা অপরিমেয় প্রাপ্তির কথাও বারবার মনে হচ্ছে। এবং তাকে যে আমরা এত দীর্ঘ সময় ধরে পাওয়ার চেয়েও বেশি করে পেয়েছিলাম, সেটাও এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর গাফ্ফার ভাইই একমাত্র মানুষ যিনি সুদীর্ঘ ও সম্পূর্ণ জীবনযাপনের পুরোটাই কর্মমুখর ছিলেন। বলা যায়, তার উপস্থিতি আমাদের জাতীয়, সামাজিক ও বিশেষ করে আমার মতো অনেকের ব্যক্তিজীবনের এতটাই ছিল যে এই বিয়োগব্যথার মধ্যেও সে অপরিমেয় প্রাপ্তির কথাও বারবার মনে হচ্ছে। বিশ্বের নানান দেশে ছড়িয়ে থাকা নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের কাজের চেয়ে সদ্য প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের জন্য কোনো কম করেননি। বরং বেশিই করেছেন। ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক জীবন্ত অভিধান, এক কিংবদন্তি পুরুষ। অর্ধশতাব্দীকাল বাংলাদেশের দেহের বাইরে থাকার পরও দেশের অন্তরটুকু বুকে করেই বেঁচেছিলেন। দেশের অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ বিষয় থেকে বড় বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে সমান মনোযোগে নিজের মতবাদ ও ভিন্নমত ঘোষণা করতে কখনো পিছপা হননি।
তিনি ছিলেন আশ্চর্য এক স্মৃতিধর ব্যক্তি। ভেবে অবাক হই, প্রতিনিয়তই তার লেখা, কথা ও বক্তব্যে কী এক অভিনব পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিগত সময়কে বর্তমানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতেন! দীর্ঘদিন আয়ুপ্রাপ্ত মানুষ তার সজাগ সময়ের সার্বক্ষণিক ব্যবহার করে গেছেন এমন উদাহরণ কেবল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীই।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সাত দশকের বেশি সময় ধরে তিনি যেন দুই হাতে লিখে গেছেন। তার এই লেখালেখির বেশির ভাগই ছিল রাজনৈতিক ভাষ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি যেটির জন্য সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হলো একেবারে তরুণ বয়সে ঢাকা কলেজে মাত্র উনিশ বছর বয়সে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে লেখা তার সেই দীর্ঘ ও সর্বগ্রাহ্য কবিতাখানা। যে কবিতাকে বাংলাদেশের এক কীর্তিমান সুরকার আবদুল লতিফ তাৎক্ষণিকভাবে সুর দিয়ে ভাষ আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিলেন। আর পরে তা পুনরায় বর্তমান বহুশ্রুত সুরে পরিচিতি দেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে যে সর্বকালের সেরা বাংলা গান বলে যে ২০টি গানকে নির্বাচিত করেছিল, তার তিন নম্বরে ছিল এটি। ১৯৫২ সাল থেকে দেশে-বিদেশে ঘরে ঘরে একুশের প্রথম প্রভাতে তা গীত হতে থাকে এক অপ্রতিরোধ্য বাণী হিসেবে, এক গভীর আত্মপ্রত্যয়ে, এক অমোঘ শক্তির আকর হিসেবে। যেন তা একটি জাতির জেগে ওঠার সোনার কাঠি-রুপার কাঠি এবং এ গান পরিণত হয়েছে জাতীয় সংগীতের পর বহুল গীত গান।
তবে এটিই আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত নয়, এই বহুমুখী মানুষটিকে মনে রাখার বহুবিধ কারণ আছে। আমার কাছে যেটা উল্লেখযোগ্য মনে হয়, তা হলো অর্ধশতাব্দীর সময় ধরে দেশের বাইরে থেকেও বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, দুর্নীতি, বাংলাদেশের সব ধরনের উত্থান-পতনকে নিয়ে তার সমালোচনা, আলোচনা এবং নির্ভীক পরামর্শ দিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা। লোকে তাকে কী বলবে বা তিনি যা বলছেন তা কি তার মনগড়া ব্যাখ্যা এসব নিয়ে তিনি ভাবেননি। ভাবেন একবারও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে লিখতে, ‘প্রধানমন্ত্রী এখন রাজাকার পরিবেষ্টিত।’ বলেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিপন্থী কর্মকাণ্ড দমাতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
মাতৃভূমি থেকে থেকে বহু দূরের দেশে বাস করেও বাংলাদেশটাকে তিনি দেখতে পেতেন আদ্যোপান্ত। বাংলাদেশে বসবাস করেও লেখক-সাংবাদিকরা রাজনৈতিক ঘনঘটার বহু জরুরি অনুষঙ্গ কিংবা টার্নিং পয়েন্টকে মিস করলেও তার অনুসন্ধানী চোখে সবকিছুই ধরা পড়ত। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাংলাদেশ বিরোধীদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপসহীন কলমসৈনিক। এখানে বিলেতে গণজাগরণ মঞ্চের পাশে, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে এবং বিজয় ফুল কার্যক্রমে তিনি দিতেন শক্তি, সাহস ও প্রেরণা। আপনি ছিলেন ইউরোপে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের শক্তি ও আশার প্রদীপ।
স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে নিবন্ধিত স্বাধীন বাংলার প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক জয় বাংলার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদকও ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে রেখে গেছেন তার অমূল্য কলামগুলো। যেখানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের লালসবুজ পতাকা অম্লান হয়ে আছে। তিনি সেখানেই চির জাগ্রত থাকবেন। তাকে প্রতি মুহূর্তে চেতনায় লালন করে যাবে আগামীর বাংলাদেশ।
বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ আপনাকে ভুলবে না প্রিয় গাফ্ফার ভাই। তিন দশকের কত স্মৃতি আপনার সঙ্গে! সেই সব স্মৃতি চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে উপস্থিত হচ্ছে বারবার। বিশেষ করে যখন আর কোনো ওষুধ আপনার জন্য অবশিষ্ট নেই। কোনো চিকিৎসাও বাকি নেই তখনো লিখে যাচ্ছেন। ফোন ধরছেন এবং তখনো নিরাশার কথা আপনার ঠোঁট থেকে অনবধানেও বেরিয়ে আসছে না। আপনার সঙ্গে আমার, আমার সন্তান ও আমার প্রয়াত স্বামী আবুল কালাম আজাদের স্মৃতির শেষ নেই। আপনার সঙ্গে আমাদের বাসায় আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কথা, দেশ নিয়ে আশা নিরাশা ও সম্ভাবনার গল্প কথা ও আপনাকে ঘিরে চায়ের শূন্য কাপের স্তূপ, গাজরের প্লেট সব মনে পড়ছে। আসলে আপনি থাকলে আসরে বা ঘরে আর কারও প্রতি নজর যেত না।
লন্ডনে থাকি বলে মনে হতো কাছেই তো আছেন। দেশ নিয়ে রাগে, দুঃখে, আনন্দে, অর্জনে ফোনটা নিয়ে দীর্ঘ কথা বলেছি। আপনার চলে যাওয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে আর তো পাব না তারে। শুধু আমি নই আমার প্রিয় মাতৃভূমির এক নির্ভীক সৈনিক আজ কত দূর চলে গেলেন!
আহ গাফ্ফার ভাই, আপনার বিকল্প শুধু আপনিই। শান্তিময় হোক আপনার এই অনন্তযাত্রা। পরম শান্তিতে থাকুন অমৃতলোকে।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী কবি